ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দর্শন সম্পর্কে মার্ক - এর ধারণাটি লেখ ।

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দর্শন সম্পর্কে মার্ক এর ধারণাটি লেখ oitihasik bostubad dhorshon somporke mark ar dharonaati lekho questions answers


উত্তর : ‘ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ তত্ত্বটি মার্কসবাদী দর্শনের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আলােচনা । সমাজ জীবনের বিশ্লেষণের দ্বন্দ্বমূলক সূত্রগুলির প্রয়ােগই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ । এই দর্শনের উদ্দেশ্য হল সমাজের উদ্ভব, বিকাশ এবং বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধন এবং তাদের সাধারণ নিয়মাবলীর বিশ্লেষণ । সেই অতীত থেকে মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনুভব করেছে সমাজ জীবন গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল পুরানাে ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব হয় । ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘ A Contribution to the Critique of Political Economy ' নামক গ্রন্থে কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কাঠামােটি তুলে ধরেছেন । মার্কসের মতে , সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই মানব ইতিহাসের মূল গতি -প্রকৃতি নিহিত আছে । উৎপাদন প্রক্রিয়ার বন্ধনে আবদ্ধ সমাজের মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়,যা তাদের নিজের চিন্তার উপর নির্ভরশীল নয় । সমাজের সম্পদ উৎপাদন ও সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে কেন্দ্র করে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কার্ল মার্কস তার নাম দিয়েছেন ,উৎপাদন সম্পর্ক বা Production Relation । সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের আপেক্ষিক ক্ষমতাই হল এই সম্পর্কগুলির মূল চালিকাশক্তি । মার্কসের মতে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থাটির সঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ ভাবে জড়িত । কারণ অর্থনীতি হল সমাজের ভিত (base ) আর এই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে উপরিকাঠামাে , এগুলি হল শিল্প,সাহিত্য , আইন , রাজনীতি , কলা ,বিজ্ঞান,  প্রযুক্তি শিক্ষাও সংস্কৃতি, মতাদর্শ ইত্যাদি । মার্কস বলেছেন , সমাজ পরিবর্তনের রহস্য লুকিয়ে আছে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই আর এখানে কোন কাল্পনিক ধারণার প্রতিফলন নেই । 



উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক আছে । ( ক ) উৎপাদক শক্তি ( খ) উৎপাদন সম্পর্ক । উৎপাদন শক্তি হল শ্রমিকের শ্রম, শ্রমের হাতিয়ার , প্রাকৃতিক সম্পদ , পরিবহন ব্যবস্থা,প্রযুক্তি,শ্রমে নিযুক্ত মানুষের অভিজ্ঞতা , খনিজ সম্পদ , বৈদ্যুতিক হাতিয়ার ইত্যাদি । আর উৎপাদন সম্পর্ক হল উৎপাদন  প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে তথা শ্রেণীতে শ্রেণীতে উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক সম্পর্ক । এই সম্পর্ক  বৈর অথবা অবৈর দুইই হতে পারে । উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রগতি হয় । আর সামঞ্জস্য না থাকলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। উৎপাদন শক্তি হল গতিশীল তাই সমাজের একটি পর্যায়ে উৎপাদন শক্তির এমন বিস্তার ঘটে, অবশেষে দেখা যায় বিদ্যমান সম্পত্তির ভারসাম্যের অভাব তখনই স্বার্থগােষ্ঠীর মধ্যে অস্থিরতা দেখা যায় । তারা আর উৎপাদন শক্তির বিকাশ হতে দেয় না ,ফলে নতুন বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে । এর ফলে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্গত দ্বন্দ্বটি তীব্রতর আকার ধারণ করে । এই ভাবে সমাজের মূল কাঠামােটি অনিবার্য ভাবে ভেঙ্গে পড়বে । এক নতুন বিপ্লব সূচিত হয়ে নতুন সমাজ কাঠামাে গঠন হবে । মার্কসবাদীরা এই দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলেছেন । 


মার্কসের মতে উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্গত দ্বন্দ্বের ফলেই আদিম সাম্যবাদী সমাজের উত্তরণ ঘটেছে । এরপর শ্রেণী বিভক্ত সমাজ বিকশিত হয়েছে । উৎপাদন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যেমন দাস দসমাজ থেকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ । এরপর অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ । এই পুঁজিবাদী সমাজে মার্কস্ দুটি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন । শ্রমিক ও মালিক , কিন্তু বুর্জোয়া মালিকরা শ্রম শক্তি ব্যবহার করে আর্থিক মুনাফা লাভ করে মার্কস বলেছেন ঐতিহাসিক নিয়মে এই স্তরের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য দরকার হল সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর এর মাধ্যমে শ্রেণী শােষণ বিলুপ্ত হবে , সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের চূড়ান্ত পর্বে সাম্যবাদী সমাজ গঠন হবে । ঐতিহাসিক বস্তুবাদের এই দর্শন মার্কসের এক বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক বিবর্তনবাদ ।


সমালােচনা : 

১ ) সমালােচকদের মতে , মার্কসবাদ অর্থনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখতে গিয়ে সমাজের অন্যান্য উপাদান এর কথা বিশেষ ভাবে তুলে ধরেন নি । 

২ ) অনেক তাত্ত্বিকদের মতে ,উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন বা দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হতে পারে না । 


৩)  সমালােচকদের মতে মার্কসীয় দর্শনে যে ঐতিহাসিক নিয়তিবাদের কথা বলা হয় তা কেবলমাত্র এক বিমূর্ত চিন্তা কারণ জগত কেবলমাত্র ইতিহাসের নিয়মে পরিবর্তিত হয় না । তাদের মতে তাহলে সচেতন জীব হিসাবে মানুষ কী নিষ্ক্রিয় দর্শক ? কারণ মানুষ সৃজনশীল , সে তার চেতনা বৃদ্ধি করে উপযুক্ত পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে পারে । 


8 ) অনেকের মতে ইতিহাসের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে কেবলমাত্র নিত্য নতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তির বিকাশের দ্বারা । এখানে উৎপাদনের দ্বান্দ্বিক নিয়ম কখনােই সমাজ পরিবর্তনের প্রধান কারক হতে পারে না । 


৫ ) কার্ল পপারের মতে ,আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে সমাজতন্ত্রের উত্থান প্রসঙ্গে কোন ঐতিহাসিক নির্দিষ্ট নিয়ম নেই , মার্কসবাদ ইতিহাসকে যান্ত্রিক ভাবে ব্যাখ্যা করেছে । 


৬ ) সমালােচকদের মতে মার্কসের নির্ধারণ করা ভবিষ্যতবাণীর সঙ্গে বর্তমান শাসন কাঠামাের কোন মিল নেই । 

৭ ) মার্কসবাদকে অনেকে আবার অর্থনৈতিক নিয়তিবাদের দর্শন বলেছেন । 

৮ ) মার্কস ভিত্তি ও উপরিসৌধের ব্যাখ্যায় সবকিছুর মূলে অর্থকে অর্থাৎ ভিত্তিকে দেখেছেন , যেন ভিত্তি ছাড়া উপরিসৌধের কোন স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা নেই।


মূল্যায়ন : এঙ্গেল বলেছেন , ডারউইন যেমন জীবজগতের বিবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ধারণাটি আরিষ্কার করেছেন , তেমনি মার্কসও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সমাজের শ্রেণী সম্পর্কের স্তরের বিবর্তনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন । এই দর্শনের ফলে আমাদের সামনে শ্রেণীতে শ্রেণীতে সম্পর্ক , সামাজিক দ্বন্দ্ব,উদ্বৃত্তমূল্য,বিভিন্ন ধরনের সমাজ ব্যবস্থার ধরন , বৈপ্লবিক পন্থা,সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের উপায় এসব বিভিন্ন দার্শনিকের ভাবনা ফুটে উঠেছে । তাই সমালােচনা সত্ত্বেও মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এক নিজস্ব স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে । আজকের বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থাতেও মার্কসবাদী দর্শন আলােচনা স্তিমিত হয়ে যায় নি । 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন