হবস্ লক ও রুশাের তত্ত্বের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লেখাে ।

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science হবস্ লক ও রুশাের তত্ত্বের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লেখাে hobos lok o rushor totter sadrisho o boisadrisho lekho questions answers


উত্তর : পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার আলােচনায় হবস ,লক এবং রুশাে এক বিশেষ স্থান লাভ করেছেন  চুক্তিবাদী দার্শনিক হিসাবে । এঁরা তিনজন একই মতবাদ স্থাপন করলেও তাদের রচনাতে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় । 

এদের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি হল 

১ ) হব , লক এবং রুশাে এই তিনজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ তাদের তত্ত্বের শুরু করেছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনা দিয়ে । 

২) এই তিন দার্শনিকগণ তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন । 

৩) হবস্ লক এবং রুশাে ছিলেন চুক্তিবাদী দার্শনিক ।

8 ) হব , লক এবং রুশাে - এই তিনজনই প্রকৃতির রাজ্যের চিত্র অঙ্কন করেছেন । 

৫ ) তিন জন দার্শনিকের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণ বা নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা ।

৬ ) এই ত্রয়ী দার্শনিকগণ সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন । 

৭ ) প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে বা কারা হবেন সে বিষয়ে তারা সচেতন ছিলেন । 

৮ ) এঁরা রাষ্ট্র ও সরকার বিষয়ে আলােচনা করেছেন । 

৯ ) এঁরা সার্বভৌম ক্ষমতার অপব্যাবহারকারীর জন্য প্রয়ােজনীয় বিধানও লিখেছেন । 

১০ ) এঁরা সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসাবে জনগণকে স্থাপন করেছেন । 



এই তিনজন দার্শনিকগণের মধ্যে বৈসাদৃশ্য আলােচনা করা হল : 


১ ) প্রকৃতির রাজ্য নিয়ে পার্থক্যঃ- এই তিন দার্শনিকগণ প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে আলােচনা করলেও এঁদের প্রকৃতির রাজ্যের চিত্রপট ভিন্ন ছিল , হবস্ তাঁর ‘ লেভিয়াথান’গ্রন্থে এক ভয়াবহ , অরাজকতায় পরিপূর্ণ প্রকৃতির রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন । প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হত । জীবন ছিল নীচ, হীন , পাশবিক , দুর্বিসহ,স্বল্প আয়ুযুক্ত। প্রকৃতির রাজ্যে কোন নৈতিক শৃঙ্খলা ছিল না । লক তার ‘টু ট্রিটিজেস অব গভর্ণমেন্ট ’নামক গ্রন্থে বলেছেন , প্রকৃতির রাজ্যের জনগণরা একে অপরকে সহযােগিতা করতাে । প্রকৃতির রাজ্যে ছিল শান্তি- শৃঙ্খলা । এখানে মানুষ তাদের প্রকৃতির অধিকার ও প্রাকৃতিক আইন ভােগ করত । অন্যদিকে রুশাে তার ‘ সােশ্যাল কনট্র্যাক্ট’ নামক গ্রন্থে আদিম মহান বন্য জীবনকে বেশী শ্রেষ্ঠ বলেছেন । এখানে মানুষ স্বর্গসুখ ভােগ করত । মানুষ ছিল নিস্পাপ ও সহানুভূতিশীল । 


২ ) সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে পার্থক্যঃ- হবসের দর্শন রচনার সময়কালে পিউরিটান বিপ্লবের চরম পর্যায় চলছিল অন্যদিকে ইংল্যাণ্ডের গৃহযুদ্ধে চরম অরাজনৈতিক পরিস্থিতি তার তত্ত্বকে প্রভাবিত করেছিল , লকের চিন্তাধারা অবতীর্ণ হয়েছিল ইংল্যাণ্ডের চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে,সুতরাং লককে ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লবের প্রবক্তা বলা হয়। তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন । অন্যদিকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ফ্রান্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকের প্রতি আলােকপাত করেন রুশাে , তাঁর তত্ত্ব দ্বারা ফরাসী বিপ্লব প্রভাবিত হয়েছিল । 


৩ ) চুক্তিমতবাদ বিষয়ে পার্থক্যঃ- হবসের মতে প্রকৃতির অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ চুক্তি করে নিজেদের অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এক চরম সার্বভৌম ক্ষমতার জন্ম দেয় ,লকের চুক্তির কারণ ছিল প্রকৃতির রাজ্যের অধিকার ও আইন সুরক্ষিত করা কারণ আইন পরিচালনার কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না তাই জনগণ চুক্তির মাধ্যমে এক সার্বভৌম কর্তৃত্ব সৃষ্টি করেছিল । রুশাের সামাজিক চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল জনগণের ইচ্ছার সমষ্টিকরণে এক সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্থাপন করা ,এই কর্তৃত্বই আধুনিক সভ্যতার প্রকৃতির রাজ্যের স্বাধীনতা ও আধুনিক কর্তৃত্ববাদ-এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা । 

8 ) সার্বভৌমিকতার উৎস - হবসের সার্বভৌমিকতার উৎস হল প্রকৃতির রাজ্যের জনগণের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন করবে এক চরম কর্তৃত্বের নিকট ।লকের মতে সার্বভৌম শক্তির উৎস হল প্রকৃতির রাজ্যের জনগণের সম্মতি প্রদান করা অন্যদিকে রুশাের সার্বভৌমিকতার উৎস হল প্রকৃতির রাজ্যের জনগণের সাধারণ ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠন গণসার্বভৌমিকতা । 


৫ ) সার্বভৌমিকতার বৈশিষ্ট্যঃ- হবস সার্বভৌম ক্ষমতাকে চুক্তির উর্ধ্বে স্থাপন করেছেন এই ক্ষমতার অধিকারী হবেন শাসক । সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম , অবাধ , অনিয়ন্ত্রিত, অহস্তান্তরযােগ্য এবং মৌলিক । সার্বভৌমের আদেশ অমান্য করার জন্য ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের অধিকারও এই ক্ষমতার আছে । লকের সার্বভৌমিকতা হল অছিমূলক ক্ষমতার বিন্যাস । জনগণের জীবন , সম্পত্তি ও স্বাধীনতার সুরক্ষা প্রদান হল সার্বভৌমের কাজ ,ব্যক্তির নিজস্ব এলাকায় এই ক্ষমতা প্রয়ােগ চলবে না । সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক । সার্বভৌম শক্তি অন্যায় করলে জনগণ বিপ্লব করে এই ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাবে । রুশাের সার্বভৌম ক্ষমতাও হবসের মতন চরম , অসীম ও অবিভাজ্য কিন্তু সাধারণের ইচ্ছার উপর এই ক্ষমতা নির্ভরশীল । এই সার্বভৌম শক্তি হল জনমঙ্গলকালী সাধারণ ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ করলে তাকে বলপূর্বক সাধারণের ইচ্ছা মান্য করতে বাধ্য করা হবে । 


৬ ) চুক্তির ফলাফল - হবসের লেখাতে চুক্তির ফলস্বরূপ এক চরম ক্ষমতাসম্পন্ন রাজতন্ত্রের জন্ম হয়েছে । লকের চুক্তির ফলস্বরূপ নিয়মতান্ত্রিক, সংসদীয় এবং উদারনীতিবাদী ভাবধারা ক্ষমতাসম্পন্ন শাসন কাঠামাে সৃষ্টি হয়েছে । রুশাের সামাজিক চুক্তির ফলস্বরূপ চরম ক্ষমতা সম্পন্ন জনগণের সার্বভৌমিকতার জন্ম হয়েছে । 


৭ ) সার্বভৌম ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা :- এই ত্রয়ী দার্শনিকগণ সার্বভৌম শক্তির সীমা সম্পর্কেও বলেছেন , হবস বলেছেন প্রকৃতির রাজ্যের জনগণ তাদের অধিকারগুলি চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমের নিকট গচ্ছিত রেখেছে মাত্র অধিকার সমর্পণ করেনি । সেই কারণে সার্বভৌম শক্তি যদি ব্যক্তির জীবনের অধিকার হরণের চেষ্টা করে তবে জনগণ ও সার্বভৌমের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ করবে ও প্রতিরােধ গড়ে তুলবে । লকের লেখায় বলা হয়েছে , সার্বভৌম শক্তি যদি জনগণের জীবন , সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অধিকারে বাধা প্রদান করে তবে জনগণও চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য সার্বভৌম কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠা করবে । রুশাের মতে সার্বভৌমিকতা কেবল সাধারণের কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে । কিন্তু পুরােপুরি ব্যক্তি স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত কোন বিষয়ে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তক্ষেপ করবে না । 


৮ ) সরকার সম্পর্কে ধারণা - হবস ব্যক্তি স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন না । তিনি চরম ক্ষমতাসম্পন্ন রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন । তিনি রাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিলেন । জন লক বলেছেন , প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র কিন্তু সরকার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মাত্র তাই জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করে সমাজ অপরিবর্তিত থাকে । লক সীমাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকারের কথা বলেছেন । রুশাের মতে সাধারণ ইচ্ছা হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা আর সরকার হল রাষ্ট্রের অধীনে কর্মচারী । রুশাে প্রকৃত গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন ।

৯ ) সমালােচনাগত পার্থক্য :- সমালােচগণ এই তিন চুক্তিবাদী দার্শনিকদের পৃথক ভাবে সমালােচনা করেছেন । যেমন হবস রাজতন্ত্রের উপর গুরুত্ব দিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করেছেন বলে তারা মনে করেন । লকের তত্ত্ব হল আধুনিক বুর্জোয়া স্বার্থের রক্ষণকারী তত্ত্ব। অন্যদিকে সমালােচদের মতে রুশাের তত্ত্বে সাধারণের ইচ্ছার উপর সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সমাজের সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করেছেন । 


মূল্যায়ন :- এই তিন দার্শনিক প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনা দিয়ে শুরু করে সামাজিক চুক্তির ফলশ্রুতি ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু তারা তিনজন তাদের দর্শনের স্বতন্ত্র মাত্রা বজায় রেখেছেন । হবস্ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন । লক প্রথম উদারনীতিবাদের জনক হিসাবে এবং রুশাে সাম্যবাদী ও আধুনিক সমাজতন্ত্রের নৈতিক অগ্রদূত হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন । হবস , লক ও রুশাে এঁরা চেয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের তাৎক্ষণিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে । সেদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে তাদের দার্শনিক চিন্তার অবদান অনস্বীকার্য ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন