উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে একটি টীকা লেখাে ৷

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে একটি টীকা লেখাে udarnitibader utportti o bikash somporke akti tika lekho questions answers


উত্তর : উদারনীতিবাদ একদিনে গড়ে ওঠেনি ।সর্বপ্রথম গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ সফিস্ট চিন্তাধারা তারা মানুষের সার্বজনীন সাম্য নীতি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিল । পেরিক্লিসের বক্তব্যতে উদারনৈতিক সাম্যবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রভাবছিল । রােমানদের রাষ্ট্রচিন্তায় সিসের বক্তব্যে উদার মনােভাব প্রকাশিত হয়েছে । এরপর মধ্যযুগের শেষ দিকে নবজাগরণের মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকার , যুক্তিবােধ , ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা বৃদ্ধিপায় । ষােড়শ শতকে ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদর্শন মূলত উদারনীতিবাদের পথকে বিস্তারে সাহায্য করেছিল । 


সপ্তদশ শতকে হবসের হাত ধরে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রকাশ ঘটে , যার থেকেই উদারনীতিবাদের ধারা গড়ে উঠেছে । জন গ্রের মতে , হবস ব্যক্তির প্রাধান্যকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন । প্রকৃতির রাজ্যের মানুষের সমান স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলেছেন । তাই লিও স্টাউস , সি.বি.ম্যাকফারসন হবকে আধুনিক উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রবক্তা বলেছেন । হবসের মতাে স্পিনােজা সর্বোত্তম জীবনের জন্য স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছেন । তিনি স্বাধীনতাকেই রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয় বলেছেন কিন্তু হবস্ ও স্পিনােজা উদারনীতিবাদের প্রাক- ঐতিহাসিক পর্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । আধুনিক যুগের উদারনীতিবাদী তত্ত্বের বিকাশে সবথেকে বড় অবদান ছিল জন লকের । লকের চিন্তাধারায় ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় আন্দোলন ,সংসদীয় সরকার , জীবন , সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অধিকার এবং পুর সমাজের গােড়াপত্তন ঘটেছে । লকের রচনাতে উদারনীতিবাদের সারবস্তু অন্তর্নিহিত হয়েছিল ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরােপীয় আলােকপ্রাপ্ত (enlightement )  - র যুগে উদারনীতিবাদের বিশেষ বিকাশ ঘটেছিল । এই যুগের দার্শনিকদের চিন্তা ধরে যুক্তিবােধে প্রাধান্য লাভ করে । তারা অন্ধবিশ্বাস ও প্রচলিত ধারণার পরিবর্তে যুক্তির আলােকে মানব সমাজের প্রকৃতি অনুধাবন করেছেন । এই যুগটি ছিল মানবতাবােধের যুগ । এই যুগের চিন্তাবিদ্গণ হলেন মন্তেস্কু , অ্যাডামস্মিথ , ডেভিড হিউম ,টম পেইন । এঁদের মতে , প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা ও মনের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার আছে । এই যুগের দার্শনিকরা ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের বিরােধ এবং সীমিত সরকারের পূজারী ।

 ঊনবিংশ শতকে ইংল্যাণ্ডে উদারনীতিবাদী তত্ত্ব বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে । শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী ক্ষেত্রে শিল্পপতিরা ব্যক্তিগত পুঁজি ও মালিকানার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে নূন্যতম পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল । ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আবশ্যক হয়ে গেলে সনাতন উদারনীতিবাদ কিছুটা পিছু হটতে থাকে । এরপর জন স্টুয়ার্ট মিলের হাত ধরে শুরু হল উদারনীতিবাদের সংশােধনমূলক তত্ত্ব । মিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী হলেও সামাজিক কল্যাণে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে মেনে নিয়েছেন । কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে উদারনীতিবাদ ও পুঁজিবাদ সংকটের মুখে পড়ে একদিকে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি অন্যদিকে আর্থিক মন্দা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নীতিকে কার্যকর হতে হল । 
 

বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হবহাউস , বার্কার, লিণ্ডসে , ম্যাকাইভার , ল্যাস্কি,গ্রীণ প্রমুখ দার্শনিকরা মিলের সংশােধনবাদী দর্শনকে মেনে নিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সংগঠিত রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন । ইংরেজ অর্থনীতিবিদ কেইনস উদারনীতিবাদকে সংশােধন এবং বাস্তবমুখী করে তুলতে অবাধ বাণিজ্য নীতির অবসান সুপারিশ করেছেন । এর পরবর্তী উদারনীতিবাদীরা পুরানাে পুঁজিবাদ ও নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করেছেন । 


বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে উদ্ভব হল ফ্যাসিবাদ , নাৎসিবাদ । ফলে সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলন , সমাজতন্ত্রের উদ্ভবের ফলে উদারনীতিবাদ সংশােধনবাদীকে ধরে রাখতে পারল না । তাদের মতে , অর্থনৈতিক জীবনের আঙ্গিকে রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের ভিত্তি হওয়া উচিত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও উদ্যোগ । নয়া উদারনীতিবাদ হল ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের এক আধুনিক সংস্করণ । এই তত্ত্বে প্রধান দুই স্তম্ভ ব্যক্তি ও বাজারের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে । 


উদারনীতিবাদ এইভাবে ক্রমশ বিকাশ লাভ করেছে ও সমৃদ্ধ লাভ করেছে । তবে উদারনীতিবাদ যতই তার তত্ত্বের পােশাক পরিবর্তন করুক না কেন উদারনীতিবাদের মূল কাঠামাে হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ , সব মানুষের নৈতিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি প্রদান, ব্যক্তি স্বাধীনতা , বানিজ্য বিকাশ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাটি অপরিবর্তিত থেকে গেছে । বর্তমান দিনেও এই তত্ত্বের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন