সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একাত্ববাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে ।

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একাত্ববাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে sarvoumikota somporke akattobadi totto bakkha koro questions answers

উত্তর : রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের চরম , অবাধ , অসীম ও অবিভাজ্য আইনগত অর্থটিই একাত্মবাদী তত্ত্ব নামে পরিচিত । একাত্মবাদের দুটি দিক কল্পনা করা যায় – পূর্ণতত্ত্বগত এবং বাস্তব । প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র হল এক এবং অদ্বিতীয় সংগঠন । রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্য কোনা সংগঠনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না । দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুসারে একাত্মবাদী সংঘের অস্তিত্ব স্বীকার করে কিন্তু সংঘগুলিকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের অধীনস্থ হতে হবে । একাত্মবাদী তত্ত্বের মূল প্রবক্তা হলেন বোঁদা , হব , বেন্থাম এবং অস্টিন ।


 আইনগত সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব অস্টিন এর রচনায় বিকাশ লাভ করে । ১৮৩২ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Lectures on Jurisprudence'- এ অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের স্বরূপ বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । ফরাসী দার্শনিক বোদা তার ‘Six Books on the Republic ' (১৫৭৬ ) নামক গ্রন্থে বলেছেন – সার্বভৌমিকতা হল আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক ও প্রজাদের উপর রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা । সার্বভৌম কতৃত্বকে উৎসস্থল বলে বর্ণনা করেছিলেন । 
 


অস্টিন ছিলেন আইনবিদ , আইনের প্রকৃতি বিচার করতে গিয়ে তিনি সার্বভৌমত্বের প্রকৃতির বিচার করেছেন । সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে অস্টিন মন্তব্যকরেছেন যে, যদি কোনাে ঊর্ধর্তন মাননীয় কর্তৃপক্ষ অপর কোন উর্ধর্তনের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে সমাজের অধিকাংশের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে , তখন ঐ নির্দিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সেই সমাজে সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী হয় এবং ঐ কর্তৃপক্ষই উক্ত সমাজ - স্বাধীন ও রাজনৈতিক সমাজ । 


সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে অস্টিনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা যায় । 

১ ) প্রতিটি রাজনৈতিক সমাজে এমন একটি মাননীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ব্যক্তি বা গােষ্ঠী থাকে যা রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা ব্যবহার করে । 

২ ) সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম , অবাধ এবং অসীম ।

৩ ) কোন ব্যক্তি বা গােষ্ঠী সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে তা নির্দিষ্ট থাকে । 

8 ) এই নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গােষ্ঠী জনগণের কাছ থেকে স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে থাকে । 

৫) সার্বভৌম ক্ষমতা অহস্তান্তরযােগ্য কারণ হস্তান্তরিত ক্ষমতা আর ফিরে পাওয়া যায় না । 

৬ ) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সমস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর এই ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে প্রযােজ্য । 

৭ ) সার্বভৌমের আদেশই হল আইন সুতরাং সকলেই এটি মানতে বাধ্য । 

৮) সার্বভৌম ক্ষমতা হল সকল অধিকারের উৎস ।



সমালােচনা : ১ ) অস্টিনের মতবাদে নির্দিষ্ট ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে যেভাবে সার্বভৌম আখ্যা দেওয়া হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এরকম মানবীয় কর্তৃপক্ষের সন্ধান পাওয়া যায় না । 

২ ) অস্টিন আইনকে সার্বভৌমের আদেশরূপে গণ্য করেছেন । তার মতে শাস্তির ভয়ে আইনকে লােকে অমান্য করে না । বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই মত অস্বীকার করে বলেন যে ,যখন রাষ্ট্র ছিল না তখন সমাজ কতগুলি সামাজিক রীতিনীতি , ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত হত । তাছাড়া আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আইন সবার উপর সমানভাবে প্রযােজ্য । যদিও অস্টিনের মতে ,উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কোনােরকম আইন মানতে বাধ্য নন । 


৩ ) আইনের প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে অস্টিনের দৃষ্টিভঙ্গির করা হয়েছে । ঐতিহাসিক পদ্ধতির বিশ্লেষণ অনুসারে আইন সমাজ গঠনের প্রয়ােজনেই সৃষ্টি হয় কোনে আইন প্রণেতার ইচ্ছায় নয় । সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্যুগুই এবং ক্র্যাবে আইনকে সামাজিক প্রয়ােজনের ফলে বলে অভিহিত করেছেন । সুতরাং এদের মতে সার্বভৌমই আইনের উৎস – এ ধারণা ঠিক নয় ।



8 ) অস্টিনের মতবাদে বল প্রয়ােগের উপর বেশি গুরুত্বদিয়ে তাকে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার  পূর্ব শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে । বর্তমান যুগে এই ধারণাকে মেনে নেওয়া যায় না । সাধারণ মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়ােজনেই আইন মেনে চলেন । তাই বলপ্রয়ােগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অস্টিন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করেছেন ।

 ৫ ) বহুত্ববাদীগণ সার্বভৌমত্ত্বের অসীম ও চরম ক্ষমতা স্বীকার করেন নি । ল্যাস্কি,বার্কার,ক্র্যাবে প্রমুখ বহুত্ববাদীদের মতে সমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও অর্থনৈতিক , সামাজিক ,সংস্কৃতিক,ধর্ম, বিষয়ক বিভিন্ন প্রকার প্রতিষ্ঠান আছে । এই প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্নভাবে মানুষের জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে । সুতরাং এই প্রতিষ্ঠান গুলিও রাষ্ট্রের মত জনগণের কাছ থেকে আনুগত্য দাবি করতে পারে ।


৬ ) বহুত্ববাদীরা আরও বলেছেন যে , আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের অবাধ ও  চূড়ান্ত সার্বভৌমিকতার দাবি ঠিক নয় । বর্তমানে কোনাে রাষ্ট্রই এককভাবে চরম বাহ্যিক সার্বভৌমকতার অধিকারী হতে পারে না । প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হয় । কাজেই কোনাে রাষ্ট্রইচরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয় ।

 
  

অস্টিনের মতবাদ বহুভাবে সমালােচিত হলেও বর্তমান কালের অনেক অস্টিনের মনােভাবকে নানাভাবে মূল্যায়ণ করেছেন । অধ্যাপক গার্নারের মতে , সার্বভৌমত্বের আইনানুগ তত্ত্ব হিসাবে অস্টিনের মতবাদ সুস্পষ্টও যুক্তিনিষ্ঠ । বস্তুত সার্বভৌম শক্তির পশ্চাতে সরকারের স্বভাবজাত আনুগত্য থাকে – অস্টিনের এই কথা থেকে বােঝা যায় যে তিনি সার্বভৌম ক্ষমতাকে  জনগণের সম্মতির ওপর গড়ে তুলেছিলেন । তবে একথা সত্য যে তিনি রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন । এখানেই অস্টিনের সার্বভৌম তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা । 
 
  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন