উত্তর : উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব হল আধুনিক যুগের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী তত্ত্ব । কিন্তুএই তত্ত্বের বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক বা রাজনৈতিক সমালােচনার অভাব নেই ।রাষ্ট্রতত্ত্ব হিসাবে উদারনৈতিক তত্ত্বের বিরুদ্ধের রক্ষণশীলতা এবং সমাজবাদ বেশ কিছু সারগর্ভ সমালােচনা করেছে । এগুলি হল —
প্রথমত : রক্ষণশীল দার্শনিকদের মতে, রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক । এই বিষয়টি উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি । একদল সমালােচকদের মতে ,উদারনীতিবাদী রাষ্ট্র কার্যত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদেরনামে ভােগবাদকে সমর্থন করে । কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতির ভােগবাদ ও ধনবৈষম্যের আধিপত্যের হাতে বন্দি হয়েছে ।
দ্বিতীয়ত : উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শন কেবল বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যের দর্শন মাত্র। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে , উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রেও প্রভাবশালী শ্রেণির চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত হয় । উদারনীতিবাদী দর্শনে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে গিয়ে কোনােটার প্রতিই সুবিচার করেননি ।
তৃতীয়ত : সমাজবাদীরা উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্বের সমালােচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে উদারনৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মানুষের গােষ্ঠীজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে । সমাজবাদীরা বুর্জোয়া বিপ্লবের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে দেখিয়েছেন ।
চতুর্থত : মার্কসবাদীদের মতে , পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া সমাজের চাহিদা মেটাতে গিয়ে জন্ম হয় উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের । ধনী বনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য , কীভাবে সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে বজায় রেখে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির বিকাশ লাভ সম্ভব হবে , ইহাই ছিল উদারনীতিবাদের লক্ষ্য বলে মার্কসবাদ ও সমাজবাদীরা মনে করেন ।
পঞ্চমত : উদারনৈতিক দর্শনে যে বিমূত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতার কথা বলা হয় তাকে প্রতিক্রিয়াশীলমূর্ত ভাবধারা বলে মনে করেন সমাজতবাদীরা । তাদের মতে ,বিমূর্ত এই ব্যক্তি স্বাধীনতার তত্ত্ব সমাজে আধিপত্যকারী বুর্জোয়া মানুষের স্বাধীনতা , একটি বিশেষ প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থের দর্শন । এই স্বাধীনতার তত্ত্বে শ্রমজীবী শােষিত মানুষের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয় না । কারণ সমাজে আর্থিক ভােগ বা বৈষম্য থাকলে সমাজে সম্পদের বন্টনের ন্যায় প্রতিষ্ঠাহয় না । তাই উদারনীতিবাদী তত্ত্ব যে ন্যায় বিচারের তত্ত্ব উপস্থিত করেছে তা সার্বজনীন নয় ।
ষষ্ঠত : নারীবাদী দার্শনিকরা ও উদারনীতিবাদ ও নব্য উদারনীতিবাদের সমালােচনা করেছেন । নারীবাদীরা বলেছেন যে , সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি খুব সচেতনভাবে নারীজাতিকে যুগের পর যুগ ধরে উপেক্ষা করে গেছে , এমনকি উদারনীতিবাদ বা নব্য উদারনীতিবাদী আন্দোলন নারীর মুক্তির প্রতি কোনাে মনােযােগ দেয়নি । এই উদারনীতিবাদী দর্শনকে নারীবাদী দার্শনিকগণ সমালােচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন ।
সপ্তমত : আবার অনেকে বলেছেন , উদারনীতিবাদ সত্যিই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে বিকশিত করে মুক্ত মনস্কতা নির্মাণকরতে পারে , তাহলে চারিদিকে এত ধর্মীয় অশান্তি কেন ? রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে চারিদিকে নাগরিকগণ মৌলবাদ , ধর্মীয় গোঁড়ামি , সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিহানা , আতঙ্কবাদের প্রভাব কেন চলছে ? উদারনীতিবাদ যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম দিয়েছে তাদের চেতনার স্তর উন্নীত করতে পারেন নি বলে একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীমত প্রদান করেছেন । সুতরাং রাষ্ট্রের মধ্যে এই অরাজকতা আর উদারনীতিবাদী দার্শনিকদের নিকট এক প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে ।
অষ্টমত : নব বা নয়া উদারনীতিবাদীরা যে কিছুটা পরিমাণে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব প্রদান করেছে , এর বিরুদ্ধে নৈরাজ্যবাদীদের মত , রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী ক্ষমতার করাল গ্রাসে ব্যক্তির আত্মিক ও নৈতিক মৃত্যু ঘটে ।
নবমত : হাক্সলির মতে , বহু সমালােচক উনবিংশ শতকের উদারনীতিবাদের ‘ Laissez -faire 'বা অবাধ বানিজ্য নীতিকে আক্রমন করেছে । এই নীতি ছিল দুর্বলকে আর্থিক শােষণের নীতি , এর ফলে মানুষের স্বাধীনতা হরণ হতে পারে ।
সুতরাং রাষ্ট্রের সীমিত ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ– উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব সমালােচনার মুখে পড়েছে । এ সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে হবে যে উদারনীতিবাদ ও নব্য উদারনীতিবাদ এককথায় পরিত্যাগ করা সম্ভব । পুঁজিবাদের সঙ্গে উদারনীতিবাদ তার পােশাক পরিবর্তন করেছে । এইভাবে উদারনীতিবাদী তত্ত্ব নিজেকে আরাে সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করেছে ।