উত্তর : ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি রামমােহনের স্পষ্টতই এক দ্বিমুখী মনােভাব লক্ষ্য করা যায়। একদিকে ব্রিটিশ শক্তিকে তিনি দেখেছিলেন ইউরােপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহক হিসাবে : আধুনিক একজন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ , লিবারাল রাজনৈতিক দর্শন ও সাংবিধানিক সরকারের ধারণা , উন্নত প্রযুক্তি ও শিল্পবিপ্লবের অতুল সম্ভাবনা — এসবের প্রতিই তাঁর চিত্ত সাড়া দিয়েছিল বিপুল ভাবে । আবার বাস্তবে তিনি ব্রিটিশ শাসনের যে রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেখানে এই আদর্শ কল্পনা থেকে বিচ্যুতি লক্ষ করে ব্যথিত হয়েছিলেন বারবার । ভারতের অনাগত সমাজবিপ্লবের দৃষ্টিকোষণ থেকে অন্তত কিছুকাল ব্রিটিশ শাসন স্বীকার করে নেওয়ার কোনাে বিকল্প নেই বলেই তিনি মনে করেছিলেন । ফলে তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই শাসনকে যথাসম্ভব মানবিক ও সহনীয় করে তােলা । রামমােহন ছিলেন প্রথম আধুনিক ভারতীয় যিনি সমাজবিজ্ঞানীদের মতাে করে অনুসন্ধান করেছিলেন কেন বারবার ভারতকে বিদেশিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে ।
ব্রিটিশ শাসনের কিছু ইতিবাচক দিকগুলি রামমােহনের দৃষ্টিআকর্ষণ করেছিল । তিনি মনে করেছিলেন এই ইতিবাচক দিকগুলি ভারতের ঐক্য ও সংহতি সৃজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । তিনি ব্রিটিশ শক্তিকে ভারতের ক্ষেত্রে এক সৃজনাত্মক ভূমিকা রূপে দেখেছিলেন । তিনি ভারতবাসীর মঙ্গলার্থে অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের জন্য ব্রিটিশ শাসনের প্রয়ােজনীয়তার কথা বার বার উল্লেখ করেছিলেন । অর্থাৎ বারতে ব্রিটিশ রাজত্ব কতদিন থাকা বাঞ্ছনীয় সে সম্পর্কে তাঁর একটা নির্দিষ্ট ধারণা ছিল । তিনি অনুভব করেছিলেন ইংরেজ শাসনের সূত্রে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্পর্শ অন্তত অর্ধশতাব্দী কাল না পেলে ভারতের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয় । এই কারণে তিনি পরাধীনতার বেদনা অনুভব করা সত্ত্বেও নবপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করার জন্য কোনাে আন্দোলন সংগঠিত করেননি । তিনি বিশ্বাস করেছিলেন ইউরােপীয়দের সাহচর্য ও সহযােগিতায় ভারত এক মহাশক্তিধর ও সম্পদশালী দেশ হিসাবে একদিন আত্মপ্রকাশ করবে ।
সর্বোপরি মনে রাখা প্রয়ােজন রামমােহন রায় তৎকালীন ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শাসনকে মঙ্গলজনক মনে করলেও ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাকে ইতিহাসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে মেনে নিতে তিনি রাজি ছিলেন না। জাকর্মর সঙ্গে কথােপকথনে তিনি বলেছিলেন ভারতের পক্ষে আরও বেশ কিছুদিন ইংরেজ শাসনের প্রয়ােজন কারণ ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করবে তখন তাকে অনেক কিছু হারাতে না হয় । তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছিলেন ।
১৮২৯ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি সতীদাহ প্রথারদ করা হয়।