রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধীজীর ধারণাটির মূল্যায়ন করাে ।

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধীজীর ধারণাটির মূল্যায়ন করাে rastrer prokriti somporke gandhijir dharonatir mullayon koro questions answers


উত্তর : গান্ধীজী অজীবন ছিলেন সত্য অহিংসা নীতির উপর অবিচল । তিনি মনে করতেন মানব জাতির মূল উপাদানটি হল অহিংসা । অহিংসার বাস্তব উপযােগিতার কথাও তিনি বলেছেন । রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সমস্ত হিংসাকে তিনি পরিহার করার কথা বলেছেন । রাষ্ট্রের মাধ্যমে সমাজের পীড়নমূলক দিকগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে । বলপ্রয়ােগ করে চরম ক্ষমতার প্রয়ােগ ঘটানাে হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা । আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল হিংসার প্রয়ােগ ঘটানাে । গান্ধীজীর মনে এই ভয় ছিল যে, রাষ্ট্রেরএই হিংসার প্রয়ােগের ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের ধ্বংস হতে পারে যা প্রগতির পথে বাধাদান করে । 


গান্ধীজী রাষ্ট্রের মূল রূপটি সম্পর্কে অবগত হয়ে বলেছেন , ‘রাষ্ট্র হল একটি কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত হিংসার মূর্ত প্রকাশ । রাষ্ট্রের কোন নৈতিক মূল্যবােধ নেই । ব্যক্তিমানবের একটি আত্মা আছে কিন্তু রাষ্ট্র একটি আত্মাহীন যন্ত্র তাই রাষ্ট্র হিংসা প্রয়ােগে দ্বিধা করে না । গান্ধীজী বলেছেন , রাষ্ট্রের মতাে হিংসার ভিত্তিতে সংগঠিত কোন প্রতিষ্ঠানকেই আমি অনুমােদন করি না ।’ রাষ্ট্র কেবল হিংসার ভিত্তিশীল নয় , অসত্য , ধ্বংস , মৃত্যু,অনৈতিকতার প্রতীক । গান্ধীজী রাষ্ট্রকে ‘ নিজেই নিজের লক্ষ্য’ (an end in itself ) বলে মনে না করে লক্ষ্যে পৌঁছানাের উপায় বলেছেন । রাষ্ট্র কোন পবিত্র প্রতিষ্ঠান নয় । মানুষের দুবর্লতা থেকেই রাষ্ট্রে জন্ম হয়েছে । তাই মানুষের কর্তব্য হল নৈতিক মূল্যবােধকে জাগরিত করে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রতিরােধ করা । কারণ , রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে হিংসার প্রকাশ দেখা যায় । গান্ধীজী রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপকে সীমিত করার পক্ষপাতী ছিলেন । ডেভিড থরােকে অনুসরণ করে গান্ধীজী বলেছেন , - ‘সেই সরকারই শ্রেষ্ঠ যা সবচেয়ে কম শাসন করে ।’ গান্ধীজীর মতে মানুষ হল নৈতিক চেতনা সম্পন্ন তাই সে নিজের ভালাে -মন্দ নিজেই বুঝতে পারে । তাই ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কোন প্রয়ােজনীয়তা নেই । তিনি রাষ্ট্রের নুন্যতম ক্ষমতা প্রয়ােগের পক্ষপাতী ছিলেন । গান্ধীজীর রাষ্ট্রের অধিকাংশ কাজ সমাজের স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান বা অছি পরিষদের হাতে দেবার কথা বলেছেন । এতে করে সমাজের কল্যান সাধন হবে । 


গান্ধীজী রাষ্ট্রীয় বা সরকারী হস্তক্ষেপের বিরােধী ছিলেন । কারণ ,তার মতে অত্যাধিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিগত উদ্যোগকে নষ্ট করে দেয়,কারণ রাষ্ট্র কেবল বলপ্রয়ােগকারী বা হিংসামূলক প্রতিষ্ঠান । এই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মানুষের আত্মনির্ভরশীলতাকে কমিয়ে দেয় । তিনি রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন , আর সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী হবে জনগণ । গান্ধীজী এক ‘রামরাজ্যের ‘ স্বরূপ কল্পনা করেছেন , যে সমাজে শােষণ থাকবে না । সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে সত্য ও অহিংসার নীতি নিয়ে । সত্য ও অহিংসার উপর গঠিত গ্রাম সমবায় হবে গান্ধীজীর রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র । সমাজে সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে । প্রত্যেক ব্যক্তি পরিচালিত হবে নৈতিক সংযমের দ্বারা । মানুষ হাতে কলমে কাজ শিখবে , কোন যান্ত্রিকতার ছাপ থাকবে না । এইরূপ রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রকে গান্ধীজী ‘রামরাজ্য’ বলেছেন ।



গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় নৈরাজ্যবাদের প্রভাব দেখা যায় । তার রাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কিন্তু নিজেকে নৈরাজ্যবাদী বলে ভাবতেন না । কারণ তিনি হিংসাশ্রয়ী বা জঙ্গীমূলক মনােভাব পােষণ করেন নি ,তিনি চিরকাল সত্য ও অহিংসার পথে চলেছেন । তিনি প্রকৃত অর্থে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধন চান নি । তিনি অমিত ক্ষমতাধর,অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রকৃতির বিরুদ্ধে দর্শন তুলে ধরেছেন । তিনি সকলের সর্বাধিক কল্যান চেয়েছেন , শ্রেণিহীন রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র চেয়েছেন , তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম- জীবনের উপর ভিত্তিশীল বুনিয়াদী গণতন্ত্রের কথা বলেছেন এবং হিংসা - প্রতিরােধের উপায় বলেছেন । তার রাষ্ট্র বিরােধীতার মূলে ছিল ব্যক্তি-মানুষের প্রতি সহমর্মিতা । এই অর্থে তিনি ছিলেন নৈরাজ্যবাদী । কোনাে কোনাে দার্শনিক তার নৈরাজ্যবাদী চিন্তাকে ‘ আলােকপ্রাপ্ত নৈরাজ্য ’ বা ‘ সুশৃঙ্খল নৈরাজ্য ’ বলেছেন । 
 

সমালােচনা - রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধীজীর চিন্তাধারা বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচিত হয়েছে । যথা – 

১ ) আধুনিক জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা অসীম তাই সত্য ও অহিংসা ভিত্তিতে গান্ধীজী যে কাল্পনিক রামরাজ্যের কথা বলেছেন তা সম্পর্কে বেশ সন্দিহান প্রকাশ করেছেন সমালােচকগণ । 

২ ) গান্ধীজীর মধ্যে দ্বৈত সত্তা লক্ষ্য করা যায় । - একদিকে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে স্ব - বিরােধিতার কথা বলেছেন ও রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র তার কাছে কাম্য ছিল । অন্যদিকে তিনি বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে মেনে নিয়েছেন 

৩ ) গান্ধীজী ব্যক্তিকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেননি কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হল জনকল্যাণকর রাষ্ট্র । এই রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য কার্যকরী আইন প্রনয়ন করে । 

৪ ) গান্ধীজী সম্পর্কে যে সমালােচনাটি বেশী আলােচিত হয়েছে তা হল গান্ধীজী নৈরাজ্যবাদী ছিলেন কি না । রাষ্ট্রের প্রতি চরম বিরূপতার জন্য ডঃ গােপীনাথ ধাওয়ান , জর্জ উডকক , ডঃ বিনয় সরকার গান্ধীজীকে নৈরাজ্যবাদী বলেছেন ,অন্যদিকে ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার , ডঃ পল পাওয়াল বলেছেন , গান্ধীজী কিন্তু হিংসাত্মক পথে রাষ্ট্রের ধ্বংস চান নি । 

৫ ) মার্কসবাদীদের মতে , রাষ্ট্র যে শ্রেণি শােষণের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে সেই দিকটি গান্ধীজী তুলে ধরতে পারেন নি । 


মূল্যায়ন - গান্ধীজীর রাষ্ট্রদর্শন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ । সমালােচনা সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে , তার রাষ্ট্রচিন্তা এক অভিনবত্বের ছাপ রেখেছে । তিনি পাশবিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ক্ষমতার সম্পর্কে ভেবেছেন , তাই তার উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং গ্রামস্তরের সকল মানুষই যেন রাষ্ট্রের আওতায় এসে নিজেদের কার্য সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় আর এখান থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি হয় । সুতরাং মানব চেতনা উৎকর্ষ বৃদ্ধিই ছিল গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তার মূল মন্ত্র ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন