মধ্যযুগীগের রাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্নগুলি তুলে ধর ।

অনাস পাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান honours pass general political science মধ্যযুগীগের রাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্নগুলি তুলে ধর modhojugider rajnoitik chintar guruttopurno dikchinhoguli tule dhoro questions answers


উত্তর : দিল্লির সুলতানগণের এবং মুঘল সম্রাটগণের অধীনস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা ঐশ্লামিক ছিল কী ছিল না এই বিষয়টি নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । মুসলিম সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী সমগ্র জগত দুভাবে বিভক্ত । একটি হল ‘ দার-উল -ইসলাম বা ইসলামের অধিক্ষেত্র’ এবং ইসলামের পবিত্র ধর্মীয় নির্দেশ যে দেশে প্রতিষ্ঠিত সেই দেশই হল দার -উল -ইসলাম । দিল্লির সুলতানগণ খলিফার আধিপত্যকে স্বীকার করেছিলেন । তাঁদের রাজ্যকে তারা দার -উল - ইসলামের একটি অংশ বলে মনে করতেন , যার আইনসঙ্গত প্রধান হলেন খলিফা । মুঘল সম্রাটদের  শাসনকালে ভারত মুসলিম আইন ‘ শর ’ দ্বারা শাসিত হতাে । অধ্যাপক কুরেশি বলেছেন  “ The political theory of Medieval Islam was based on the teachings of the qurian , the troditions of the prophet , precedents and Greek thought. ” ( মধ্যযুগের ঐশ্বামিক রাজনৈতিক তত্ত্ব কুর-আনের বাণী ,ধর্মপ্রচারকদের ঐতিহ্য , অনুসৃত পদ্ধতি ও গ্রিক চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল ।) রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক জীবনে অনুসরণীয় বিস্তৃত নীতিগুলিই শুধুমাত্র কুর-আনে লিপিবদ্ধ করা ছিল । সমস্ত মুসলিমদের মধ্যে এক্য ও সংহতির প্রয়োজনীয়তাকেই কুর-আনে গুরুত্ব দেয় । সংগঠিত মুসলিম সমাজকে পরীক্ষা করার যেকোনাে প্রচেষ্টাই কুর-আনে নিন্দনীয় । প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষকে মান্য করা সমস্ত  আলাপ আলােচনার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজের মুসলিমদের পক্ষে বাধ্যতামূলক । আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজের বিষয়গুলি পরিচালনা করার কথাও কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে । ক্ষমতার অপব্যবহার রােধ করার জন্য কোরানে বলা হয়েছে । “ একজন মানুষের প্রথম আনুগত্য আল্লার কাছে । সুতরাং ধর্মের বিধান লঙ্খনকারী কোনাে কর্তৃপক্ষকে মান্য করা একজন ধর্ম বিশ্বাসীর উচিত নয় ।” 


ধর্মীয় রাষ্ট্র: মধ্যযুগের ভারতে মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রকৃতির ছিল কিনা এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামধর্ম প্রবেশ করতে পারেনি । সুতরাং মধ্যযুগের ভারত না বলে তুর্কি শাসনাধীন ভারত কথাটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তুর্কি শাসনকালে অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রের মতােই ভারতও ছিল ধর্মীয়। অধ্যাপক শ্রীবাস্তব বলেছেন : “ The trukish state of India , like all Isslamic states ,was a theocracy , It was based on the Islamic law as given in quran and the Hadis ....” । মুসলিম অধিকৃত ভারতকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বলার অনেকগুলি কারণ ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন । প্রথমত , কোরান ও হাদিসের বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হতাে । (“ কোরান শরিফ : আল্লাহর বাণী সংকলন গ্রন্থ । এ কোনাে মানুষের রচনা নয় — স্বয়ং আল্লাহই এ গ্রন্থের রচয়িতা ) সুতরাং কোরান শরিফ নির্দেশিত পথেই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হতাে — যে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই । দ্বিতীয়ত , রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম সার্বভৌমত্ব এবং আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যে একটি সমীকরণ রচিত হয়েছিল । তৃতীয়ত , ঐশ্বরিক বিধান অনুযায়ী আল্লাহর মনােনীত ধর্মপ্রচারকগণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালিত হতাে । দিল্লির সুলতানগণ আল্লাহর মনােনীত প্রতিনিধি - খলিফার অধীনস্থ বা সহকারীরূপে নিজেদের মনে করতেন । চতুর্থত , রাষ্ট্রের আয়ের সমস্ত উৎসগুলিই ধর্মপ্রচার ও প্রসারের কার্যে নিবেদিত হতাে ।  
পঞ্চমত , ইসলাম ধর্ম তত্ত্বে, মুসলিম  রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক হলেন আল্লাহ । জাগতিক শাসক হলেন তার প্রতিনিধি । কুরআন নির্দেশিত বাণীগুলিকে বাস্তবায়িত করাই সেই জাগতিক শাসকের পবিত্র কর্তব্য । ধর্মতত্ত্ব অনুশারী এই সার্বভৌম প্রতিনিধি ‘ মিলাত ’ অর্থাৎ রাষ্ট্রের মুসলিম পুরুষদের সংস্থা কর্তৃক নির্বাচিত হবেন । 

মধ্যযুগের ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিক । সংগঠিত কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল এই সাম্রাজ্যের ক্ষমতার মূল উৎস । আমলাতন্ত্রের  এই আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণও ক্ষমতার উৎস ছিলেন সম্রাট , তিনি এই আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতেন । উত্তরাধিকারী নয় যোগ্যতা ও দক্ষতাই ছিল আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য । দিল্লির সুলতানি পর্ব এবং পরবর্তী মুঘল - পর্ব কোনাে সময়েই বলিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রথা গড়ে ওঠেনি । ঔরঙ্গজেবের পূর শাসকের যােগ্যতা ও দক্ষমতার অভাব আমলাতন্ত্রিক ব্যবস্থাকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুও ধ্বংসােন্মুখ করে দেয় । বিশাল বৈচিত্র্যময় সামগ্রিক ও অসামরিক আমলাতান্তিক শাসন যােগ্য নিয়ন্ত্রকের অভাবে বহিঃশত্রুর চতুর ও কূটনৈতিক আক্রমণের মুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে । মুঘল - যুগের অবসানেও সামন্ততন্ত্রের অবসানে ইউরােপীয় বণিকশ্রেণির আগমন সূচিত হয় । 


       মুঘল - শাসনব্যবস্থাকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অনেক ‘জাতীর শাসনব্যবস্থা এবং মুঘলযুগকে ‘age of Indian Nationalism ' বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যুগ বলে বর্ণনা করেছেন । ব্রিটিশ শাসনের পূর্বসূরি মুঘল - শাসনব্যবস্থা তার সুদীর্ঘ শাসনে ভারতীয়ত্ব অর্জন করেছিল । বিদেশি ইউরােপীয় জাতির আধিপত্য ও অধীনতার বিরুদ্ধে দেশাত্মবােধ জাগ্রত করার উদ্দেশ্যেই তারা মূঘলযুগকে ‘ জাতীয়তাবাদের যুগ ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন । দ্বিতীয়ত, দিল্লির সুলতানি শাসন (১২০৬-১৫২৬ ) অপেক্ষা মুঘল - শাসন অনেক বেশি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও উদারতার পরিচয় দিয়েছিল । তৃতীয়ত , বহুধা বিভক্ত জাতপাত ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভারতে মুঘল - বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক মহামতি আকবরের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও জনগণের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা তাঁদের প্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । তবে এই মতের বিরুদ্ধে ড . শ্রীবাস্তব বলেছেন : " The principle on which the Mughal Administration was based were both boreign and India. ”। সুতরাং মধ্যযুগের শাসনব্যবস্থার কাঠামাে ছিল পারসিক - আরবীয় , তুর্কি-মঙ্গল (মধ্য -এশিয় ) ও ভারতের ভাবধারার মিশ্র রূপ । কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলি এবং রাজস্ব ব্যবস্থা (ভূমিরাজস্ব ব্যতীত ) পারসিক আরবীয় কাঠামাের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল । সেনা প্রশাসন গঠিত হয়েছিল মধ্য এশিয় ধাঁচে । প্রধানত পারসিক ও আরবীয় ব্যবস্থা থেকে সরকার পরিচালনার নীতিসমূহ , ধর্মীয় নীতি , বিভাগীয় পদ্ধতি এবং আধিকারিকদের উপাধিগুলি গ্রহণ করা হয়েছিল । ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণত ভারতীয় পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল এবং বিচার বিভাগের সংগঠনে ভারতীয় উপাদানের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না । মুঘলদের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় ভারতীয় প্রভাবের অস্তিত্ব লক্ষণীয় ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন