উত্তর : ভারতের আধুনিকীকরণের আলােকচ্ছটা স্বরূপ জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে কঠোর মােড়ক রাখা শিক্ষা ও সংস্কৃতির পশ্চিমী ... নার অন্যতম তাত্ত্বিক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি প্রচলিত প্রথার বাইরে বেরিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনাকে স্থাপন করেছিলেন । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি যেমন জেহাদ ঘােষণা করেছেন , ঠিক তেমনই ব্রিটিশদের ভালাে দিকগুলােকেও তিনি গুরুত্ব সহকারে বিচার বিবেচনা করেছিলেন । ‘ আনন্দমঠ’কে অবলম্বন করে তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে দিক থেকে দিগন্তে ।
সীমাহীন জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র: মূলত জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ধারণার মধ্য দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্রের রাষ্ট্রদর্শন বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে । তাঁর সমকালীন ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের ধারণা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট । তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয়দের কাছে জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন । তিনি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে জন্মভূমির প্রীতি তথা দেশপ্রেমের মহান আদর্শের সাথে একাত্ম করে তুলেছিলেন । তিনি একান্ত আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলেছেন — “ যে জাতি জন্মভূমিকে সৰ্গাদপী গরিয়সী মনে করতে না পারে সে জাতি জাতিমধ্যে হতভাগ্য । ” এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র জননী জন্মভূমির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাও নিমগ্ন স্বদেশ প্রেমের মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবাদের ধারণা গড়ে তুলেছিল ।
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের দেশমাতৃকা : বস্তুতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মহান উদ্গাতা । স্বদেশপ্রেমের মহান আদর্শের মধ্যে দিয়ে তিনি ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করেছিলেন । আর এই উদ্দেশ্যেই তিনি আনন্দমঠ ,দেবী চৌধুরানী , সীতারাম , ইত্যাদি প্রবন্ধ। এইসব রচনাগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের বার্তা ভারতীয়দের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেছিলেন । দেশমাতাকে দেবীদুর্গার প্রতিমূর্তি হিসাবে কল্পনা করে তিনি ভারতীয়দের মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের এক আমবগময় অনুভূতি গড়ে তুলেছিলেন ।
জাতীয়তাবাদ ও আনন্দমঠ : বঙ্কিমচন্দ্র ভারতমাতাকে দেবী সত্তায় ভূষিত করে জাতীয়তবাদকে দৃপ্ত মহিমায় মূর্ত করেছিলেন তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাস । তিনি আনন্দমঠের দেশপ্রেমিক সন্ন্যাসীগণকে মতৃমন্ত্রে দীক্ষিত, আত্মমন্ত্রে নিবন্ধিত ও উৎসর্গীকৃত প্রাণ এবং দেশমাতার মুক্তির লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প ধর্মযােদ্ধা হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন । তাই আনন্দমঠের দেশভক্ত সন্ন্যাসীদের ধর্মযুদ্ধই যেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে এবং সেই ধর্মযুদ্ধই ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ তথা সংগ্রামী ও বিপ্লবী নেতৃবৃন্দকে জাতীয় মুক্তি। সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন । বস্তুত পক্ষে আনন্দমঠ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র।
পরম দেশভক্ত এবং দেশমাতার মুক্তির সাধনায় আত্মনিবেদিত চরিত্র সাধক ভবানন্দের কণ্ঠে দেশ মাতৃকার বন্দনাস্বরূপ যে মাতৃবন্দনা গীতি চেয়েছিলেন সেই বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি ভারতমাতার বাণুমূর্তির রূপ লাভ করেছিল ।
দৈবশক্তি ও জাতীয়তাবাদী : বস্তুতপক্ষে ভারতমাতার বন্দনায় মুখর বন্দেমাতরম সঙ্গীত চেতনার উদ্বোধিত স্বপ্নকামনায় উন্মুক্ত দেশভক্ত সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী চেতনায় উদ্বোধিত আনন্দমঠ উপন্যাসটির মধ্যে দিয়ে দৈবশক্তিকে সামনেরেখে বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদের ধারণাকে মূর্ত করে তুলেছেন । এই উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন যে দেশভক্ত সন্ন্যাসীগণ জন্মভূমি ছাড়া অপর কাউকে মা বলিয়া স্বীকার করে না। তিনি ভারতমাতাকে দেবীরূপে কল্পনা করে দেবীর নিকটে তথা মায়ের নিকটে আত্মবলিদান দিতে ভারতীয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে বলেছেন । তিনি এখানে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন জাতীয়তাবাদের জীবনকাঠি হিসাবে । তিনি মনে করতেন জাতির সুখ ও মুক্তির বিধান করাই হল জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য । তাই তিনি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটিকে জাতির সুখ -দুঃখের মানতণ্ডে বিচার করেছেন ।
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ছিল ভারতীয়দের নবজাগরণের পদধ্বনি । তিনি তাঁর শ্লেষ এবং ব্যাঙ্গার্থক রচনার মধ্যে দিয়ে যেমন বাঙালিকে সােজা করতে চেয়েছিলেন তেমনি দেশ মাতৃকার স্পর্শে আনন্দমঠের মাটি লাগিয়ে তিনি মৃন্ময়ী মূর্তিকে চিন্ময়ী মূর্তিতে পরিণত করতে চেয়েছেন ।তিনি এই ভাবনায় ছিলেন যে চেতনার রঙিনত্বে নয় , দৃঢ় বাস্তবের আগুনে তিনি বাঙালি ততা ভারতবাসীকে পােড়াতে চেয়েছেন । যাতে তার পুনঃজন্ম হয় , যাতে চেতনার অবিশ্রিতায় জাতি হিসেবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন । তাঁর জাতীয়তাবাদ দেশপ্রেমের এক গভীর জীবনবােধ থেকে উৎসারিত । এখানেই বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের যথার্থ ।